জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছাকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ।। জ্ঞানের সন্ধানে।। পেইজটি। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে। সর্বশেষে ।। জ্ঞানের সন্ধানে।। পেজ এর পক্ষ হতে আপনাকে স্বাগতম জানাই।

শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪

পথশিশুদের পত্রিকা

ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লীতে শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করছে পাঁচ লক্ষেরও বেশি শিশু। পুরো দেশে এই সংখ্যা এক কোটি দশ লক্ষেরও বেশি। এই শিশুদের বড় একটি অংশ বাস করে বস্তিতে । তাদের অধিকাংশই নেশায় আক্রান্ত । লেখাপড়া নেই । নেই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার । দু বেলা দু মুঠো খাবার জোগারের আশায় দিন রাত এরা খেটে মরে । অভাবের তাড়নায় পরবর্তীতে এই শিশুরাই খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে । সরকার এবং উচ্চবিত্তদের কাছে এই শিশুরা অনেকটা ভূতের মতো । ভূত যেমন দেখা যায় না, এই শিশুদেরও তারা দেখতে পান না । এদের উন্নতির জন্য এগিয়ে আসে না কেউই । তাদের এই দুঃখ কষ্ট প্রকাশ করে না কোনো টিভি কিংবা পত্রিকা । এরকম পরিস্থিতিতে নিজেরদের দুঃখ কষ্টের কথা প্রকাশ করতে ওরা নিজেরাই বের করেছে একটি পত্রিকা ।

বালকনামা । বাংলা করলে এর অর্থ দাড়ায় শিশুদের বাণি । ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লীর বস্তিতে বাস করা শিশুদের পত্রিকা এটি । দরিদ্র শিশুদের তৈরী আর কোনো পত্রিকা পুরো পৃথিবীতে প্রকাশ হবার নজির নেই । অলাভজনক প্রতিষ্ঠান চেতনা এই পত্রিকাটির বের করার পেছনে অবদান রেখে চলেছে।
বস্তি এবং রাস্তার পাশে বাস করা শিশুদের নির্বাচিত লেখা নিয়ে প্রকাশ হয়ে থাকে বালকনামা। প্রথম দিকে এর লেখক তালিকায় ৩৫ জন পথশিশু থাকলেও এখন সেই সংখ্যা একশ’রও উপরে। এখন শুধু দিল্লীর শিশুরা নয়, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও অন্ধ্র প্রদেশের পথশিশুরাও লিখছে বালকনামাতে।

ত্রৈমাসিক এই পত্রিকাটি প্রকাশ হয় হিন্দি ভাষায়। সিরিয়াস বিষয়, যেগুলো পথশিশুদের সমস্যার কথা প্রকাশ করে-এমন ধরনের লেখা ছাপা হয় এখানে। যেমন পথশিশুদের উপর সাধারণ মানুষ ও পুলিশের অত্যাচার, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, খাবার ও বাসস্থানের সমস্যা ইত্যাদি। মোটকথা বালকনামা পথশিশুদের দৈনন্দিন জীবনের কঠিন সত্য প্রকাশ করে।


১৮ বছর বয়সী বিজয় কুমার পত্রিকাটির চিফ রিপোর্টার। নির্বাহি সম্পাদক হিসেবে আছেন ১৬ বছর বয়সী চাঁদনি। তার কাজ সবার কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করা। কোন লেখাটি ছাপা হবে সেটা বাছাই করাও তার কাজ। জ্যোতির বয়স ১৪ বছর। ডাস্টবিন থেকে ময়লা কুড়ানোর কাজ করে সে। পাশাপাশি বালকনামার একজন প্রদায়ক প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করছে। একই ভাবে ১৬ বছরের শম্ভু দিনের বেলা গাড়ির ধোয়ামোছার কাজ করে। রাতে কাজ করে হোটেলে। এত কাজের পাশাপাশি প্রদায়ক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করছে বালকনামায়।


এবার পরিচিত হওয়া যাক পত্রিকার সম্পাদকের সাথে। তার নাম সান্নো। ১৯ বছর বয়সের এই তরুনী লেখাপড়া শিখেছেন অবৈতনিক বিদ্যালয়ে। নিরব এলাকায় গাছের নিচে চলত তাদের ক্লাস। সান্নোর কলমের ধার তীব্র। লেখাপড়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে নিয়মিত লিখছেন তিনি। তার লেখায় সরকারের যেমন সমালোচনা থাকে, তেমনি সমালোচনা থাকে অবিভাবক, সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েও। বালকনামার সব লেখক এবং প্রদায়করা সমাজের সামান্য পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করে চলেছেন।





চাঁদনি বলেন,‘সমস্যা হচ্ছে, আমাদের আশেপাশের কেউ জানতে চায় না আমরা পথশিশুরা কিভাবে বেঁচে আছি। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখতে পারছি, না নষ্ট হয়ে যাচ্ছি। সেকারনে আমরা ঠিক করেছি, যারা আমাদের থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে চান, পত্রিকার মাধ্যমে তাদের দৃষ্টি আমাদের দিকে ফেরাবো।’


তিনি আরো বলেন,‘বালকনামায় যেসব শিশুদের লেখা প্রকাশিত হয়, সত্যি বলতে তাদের পৃথিবী অন্ধকারে ঢাকা। পত্রিকাটির মাধ্যমে এই সব অসহায় শিশুরা তাদের জীবনের গল্প অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে চায়।’

পত্রিকাটির প্রদায়ক জ্যোতি বলেন,‘আমাদের লেখকদের অনেকেই একসময় লেখাপড়া জানতেন না। তারা আমাদের কাছে লেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে আমরা তাদের অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই। সেখানে লেখাপড়া শিখে তারপর বালকনামায় কাজ শুরু করেন তারা। তবে যারা আগে থেকে লেখাপড়া জানেন, তাদেরকে লেখার আগে আমরা কিছু পরামর্শ দেই। কিভাবে লিখতে হবে-সেই পরামর্শ। সাথে থাকে পত্রিকা। সেগুলো পড়েও আমাদের লেখকরা লেখার ধরণ বুঝতে পারেন এবং লেখার ব্যাপারে নতুন নতুন আইডিয়া পান।’

              



প্রদায়ক প্রতিবেদক শম্ভু বলেন,‘আমার মতো এক ছেলের কাছে পত্রিকায় লেখার ব্যাপারটা ছিলো স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো। এক সময় আমি নেশা করতাম। মদ গাজা সিগারেট ছিলো নিত্য সঙ্গী। সারাদিন সামান্য যা আয় করতাম, তার পুরোটাই ঢেলে দিতাম নেশার পিছনে। এখন আমি অনেক সচেতন হয়েছি। নেশা ছেড়েছি অনেক আগেই। নেশার বিপক্ষে লিখতে শুরু করেছি বালকনামাতে। যে সব শিশুরা এখনো নেশার ঘোরে হাপিত্যেশ করছে, তাদেরকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনাই আমার লক্ষ্য।’

অলাভজনক সংস্থা ‘চেতনা’পত্রিকা বানানোর খরচ বহন করে থাকে। পত্রিকা প্রকাশ হওয়ার পর এরাই নামমাত্র মূলে সেগুলো পাঠকদের কাছে বিক্রি করে। প্রতি কপি এক রুপিতে বিক্রির পর সামান্য যা লাভ হয় সেগুলোও তারা ব্যায় করে পথশিশুদের কল্যানে।

সম্পাদনায়ঃ দুরন্ত নাঈম