হাওড়-বাওড়, বিল-ঝিল জলাশয়, যেখানে রয়েছে নলখাগড়া বা অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ, পদ্মবন ইত্যাদির আধিক্য বেশি যেখানে, সেখানেই দেখা যেতে পারে কালো কালো মুরগির মতো এক ধরনের পাখিকে। একটি নয়, কখনও জোড়ায় বা কখনও-কখনও দলবল নিয়ে ওরা ঘোরাফেরা করে। অনেকেই দেখে হুট করে জলপিপি বলে ভুল করতে পারে। এটির নাম জলমুরগি। ইংরেজি নাম মুরহেন (Moorhen) আর বৈজ্ঞানিক নাম Gallinula chloropus।
নিরাপদ দূরত্বে থেকে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এই জলমুরগিগুলো সাঁতার কাটছে মাথাটাকে সামনে পেছনে করে করে। লেজ তুলে চলেছে বলে কারও পেছনটা দেখা যাচ্ছে। কেউ-কেউ নলের উপর পা আঁকড়ে বসে আছে। আবার দু-একটা পাখি অন্যমনষ্কভাবে হেঁটে-হেঁটে খাবার খুঁজছে।
আমাদের দেশে স্থায়ী বাসিন্দা জলমুরগি যেমন আছে, তেমনি শীতের অতিথি হিসেবেও প্রচুর জলমুরগি আমাদের দেশে আসে। ওরা জোড়ায়-জোড়ায় বা ছোট দলে, ঘুরে বেড়ায়। আবার শীতের অতিথিরা এলে ৫০/৬০টির দলও হয়।
ওরা পানিতেই বেশির ভাগ সময় কাটায়। পদ্ম, শাপলা কিংবা অন্যান্য জলজ লতাগুল্ম ঠেলে ঠেলে ওরা শব্দহীন সাঁতার কাটে। সামান্যতম বিপদের সংকেত পেলেই আত্মগোপন করে জলজ উদ্ভিদের আড়ালে। তখন এক ধরনের আওয়াজ করে ওরা। আওয়াজটা হয় অনেকটা ‘কাড়–ক-কুড়–ক’ধরনের।
আত্মগোপন করার সময় ডানার চেয়ে পায়ের কাজটা-ই বেশি হয় ওদের। আর বিপদ বড় হলে জল ছেড়ে ওড়াল দেয়। অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেই যেন ওরা ওড়ে। তখন পা দুটো ল্যাগব্যাগ করে ঝুলতে থাকে। মনে হয় ওড়াটা ওদর খুব পছন্দ নয়। কিন্তু যখন দেশান্তরী হয়, তখন ওরা অবলিলায় বড়-বড় পাহাড় পর্বতের ওপর দিয়ে চলে যায় দূরদূরান্তে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে। প্রয়োজনে ওরা ডুব-সাঁতারও দিতে পারে। ওরা আনন্দ প্রকাশ করার সময় জলকেলী করে ডুব-সাঁতার দিয়ে-দিয়ে। তখন দৃশ্যটি হয় দেখার মতো।
জলমুরগি লম্বায় প্রায় ৩২ সেমি পর্যন্ত হয়। ওদের শরীরের উপরের অংশ কালো, শে¬টধূসর আর পাটকিলের মাখামাখি। পাখা বন্ধ থাকলে একটা সাদা ছোপ দেখা যায় ডানার নিচের দিকে। তার নিচ থেকে আবার ধূসর থেকে ক্রমে ফিকে রঙ। পেটের মাঝখানে শাদাটে আভা। লেজের তলা সাদা এবং মাঝে-মাঝে কালো ছোপ। ঠোঁট সবুজ, কপালে লাল বর্ম। চিকন-চিকন আঙুল সমৃদ্ধ শরীরের তুলনায় লম্বা পাগুলোও সবুজ। চোখের তারা উজ্জ্বল লাল বর্ণের।
সব কিছুই খায় এই জলমুরগিরা। নানা ধরনের বীজ, জলজ উদ্ভিদের ডগা বা ফল যেমন খায়, তেমনি অরুচি নেই শামুকেও। কীটপতঙ্গ ও তাদের শূক, পোকামাকড়, ব্যাঙাচির পাশাপাশি ছোট ছোট মাছও ধরে-ধরে খায়। কোনো কিছুতেই অরুচি নেই ওদের। মাঝে-মাঝে দেখা যায়, সন্ধ্যানাগাদ কিংবা খুব ভোরে ওরা ঝিল বা হাওড় এলাকা ছেড়ে চলে যায় খেতের জমিতে, খাবারের সন্ধানে। ওরা জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতেও চরে কখনও-কখনও।
বর্ষাকালই ওদের প্রজনন ঋতু। অর্থাৎ মে থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে ওরা বাসা করে। ডিম-বাসা তোলে। নগলখাগড়ার ঝোপের ভেতর পানি থেকে ১৫-২০ সেন্টিমিটার ওপরে ওরা বাসা করে। বাসার উপকরণ চিকন-চিকন শুকনো কাঠি ও নলখাগড়ার পাতা। কখনও পানির দিকে ঝুঁকে পড়া গাছেও বাসা করে। ৬ থেকে ১৬টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে ওরা। ডিমের রঙ হালকা হলুদ, তার উপর গাঢ় লাল রঙের ছিট ছোপ। স্ত্রী-পুরুষ দু’জনেই এক সঙ্গে বাসা বানায়, ডিমে তা দেয়। দুজনে পালা করে সন্তান লালনপালন করে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয় ২০-২১ দিনে।
লেখকঃ রহীম শাহ।
সম্পাদকঃ দুরন্ত পথিক।