জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছাকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ।। জ্ঞানের সন্ধানে।। পেইজটি। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে। সর্বশেষে ।। জ্ঞানের সন্ধানে।। পেজ এর পক্ষ হতে আপনাকে স্বাগতম জানাই।

শুক্রবার, ৯ মে, ২০১৪

ঐতিহাসিক বালাকোটঃ আযাদী আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস


উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে বালাকোট এক চিরস্মরণীয় নাম। এর সঙ্গে জড়িত মুসলমানদের স্বাধীনতা, অস্তিত্ব ও জাগরণের ইতিবৃত্ত; পথহারা উম্মতের সঠিক পথের নির্দেশনা। ইংরেজ আমলে পরবর্তী সময়ে সংঘটিত প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থান বালাকোটের চেতনার ফসল। বালাকোটের ঐতিহাসিক ট্রাজেডির মাধ্যমে সূচিত সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়েই এ দেশের মুসলমানরা ফিরে পেয়েছিল তাদের স্বাধীনতা।

বালাকোট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন সৈয়দ আহমদ (রহ)। তিনি ১৭৮৬ সালের নভেনব্র মাসে জন্মগ্রহণ করেন। মুজাদ্দিদে আলফে সানীর সূচিত সংস্কার ও সংগ্রামের ধারার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন আরেক সংগ্রামী সংস্কারক শাহ ওয়ালীউল্লাহ(রহ) এর ছেলে শাহ আব্দুল আজীজ (রহ) এর ছাত্র,যিনি সর্বাগ্রে দিয়েছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া।শাহ আব্দুল আজীজ(রহ) এর আদেশেই সৈয়দ আহমদ (রহ.) জিহাদে নেমেছিলেন। তার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল মূলত দুটি উদ্দেশ্যে, 
০১) পারিপার্শ্বিক অন্যান্য জাতির প্রভাবে কলুষিত মুসলিম জাতির ঈমান-আকিদাকে শিরকমুক্ত করা।
০২) মুসলিম জীবনধারা ও জাগরণের অন্তরায় অশুভ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। অস্তিত্ব হারাতে বসা মুসলিম জাতির জন্য তখন এ দুটি কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত যগোপযোগী ও প্রয়োজনীয়।

মোঘল সালতানাতের পতনের সঙ্গে সঙ্গে উপমহাদেশের মুসলমানরা নিপতিত হয় চতুর্মুখী সমস্যায়। একদিকে জাঠ-মারাঠা-শিখ প্রভৃতি মুসলিম বিদ্বেষী শক্তিগুলোর ব্যাপক অভ্যুত্থান শুরু হয়, অপরদিকে বাংলার শাসন ক্ষমতায় ইংরেজ বণিকদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে অশুভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সে সময়ে মুসলিম জনগণের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। মসজিদে আজান এবং জুমার জামাত বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থার ভয়াবহতা সেই সময় সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ)কে আন্দোলনের পথে তাড়িত করে। তিনি প্রথমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় সংস্কারের লক্ষ্যে ব্যাপক তাবলিগী সফর শুরু করেন। সে যুগে মুসলমানদের অবস্থা এরকম হয়ে গিয়েছিল যে, অনেকেই সে সময় হজ্জ্ব করার প্রয়োজন নেই বলে ফতোয়া দেয়া শুরু করেছিল। এ কুধারণা ভাঙ্গতেই তিনি তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে দীর্ঘ হজ্জ্বের সফর সমাপ্ত করেন।

তার আন্দোলনে অনেক বাংলাদেশী যুবক শরীক হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকেও অনেক মুজাহিদ এ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে মাওলানা ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী ও সুফি নূর মুহাম্মদ ছিলেন শীর্ষ পর্যায়ে। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের এক পরদাদা গাজী আশেকুল্লাও ছিলেন এ পর্যায়ের এক সংগ্রামী আলেম।

দু বছর এগার মাসের হজের সফর সমাপ্ত করে সৈয়দ আহমদ রহ. তার জন্মস্থান রায়বেরেলী পৌঁছেন। দেশে এসে তিনি তার আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেন সর্বত্র। জনগণের জন্য মুক্ত স্বাধীন দেশে আল্লাহর বন্দেগী করার মতো মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন। নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে তার আন্দোলনে জড়াতে থাকে।

এ সময় ব্যাপক গণসংযোগের দ্বারা তিনি প্রায় ছয় হাজার সঙ্গী-সাথী সংগ্রহ করেন। তাদের সংগঠিত করে সীমান্ত এলাকায় চলতে থাকা মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ইংরেজ রাজশক্তির মদদপুষ্ট শিখ রাজার শোষণ প্রতিরোধকল্পে ১৮২৬ খৃষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। শিখ রাজা রঞ্জিত সিংকে প্রথমে পত্র মারফত মুসলিম নির্যাতন বন্ধ করার আহবান জানানো হয়। শিখ রাজা পত্রের কেনো জবাব না দিয়ে মুজাহিদদের কাফেলাকে শায়েস্তা করার জন্য সরদার বুধসিংয়ের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেয়। মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল শিখদের সর্বপ্রথম মোকাবেলা। এতে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। এরপর ‘হাযারা’ নামক স্থানে দ্বিতীয়বার সংঘর্ষ হয়। এতেও শিখরা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়। এই বিজয়ের ফলে মুসলমানদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়। এসব যুদ্ধের পেছনে কারণ ছিল মুসলমানদের জীবন নিপীড়নমুক্ত করা, ইংরেজ ও ইংরেজপোষ্য শাসকদের কাবু করা। সম্প্রদায়গতভাবে শিখদের সঙ্গে লড়াই করা তার লক্ষ্য ছিল না। সে সময় মুজাহিদীন ও উপজাতীয় সরদারদের এক সমাবেশে সৈয়দ আহমদ শহীদকে ‘আমিরুল মুমেনিন’ করে ইসলামী খেলাফতের গোড়াপত্তন করা হয়। আর উনার প্রধান সেনাপতি ছিলেন শাহ ইসমাইল শহীদ (রহ) এবং মূল প্রচারক ছিলেন মাওলানা আব্দুল হাই(রহ)।মুজাহিদ বাহিনীর আন্দোলন এতে নতুন মোড় লাভ করে।আর উনার প্রধান সেনাপতি ছিলেন শাহ ইসমাইল শহীদ (রহ) এবং মূল প্রচারক ছিলেন মাওলানা আব্দুল হাই (রহ)।

কিন্তু সৈয়দ আহমদ রহ.-এর এই আন্দোলনে উপজাতীয় পাঠানদের সমর্থন ছিল না। কারণ, শিখদের সঙ্গে এদের নানা ধরনের বৈষয়িক স্বার্থ জড়িত ছিল। যুগ যুগ ধরে তারা গদি দখল করে সাধারণ জনগণকে শোষণ করে আসছিল। তাই সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে তাদের একটি সুস্পষ্ট বিরোধ জন্ম নেয়। ফলে তারা শিখদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গোপন চক্রান্তে মেতে উঠে। সংঘটিত হয় ‘সিদুর’ যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধে মুজাহিদদের আংশিক পরাজয় ঘটে। নানামুখী প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্রের কারণে তারা কিছুটা দমে যান। এরই মধ্যে ঘটে এক করুণ ঘটনা। একদিন মুজাহিদরা এশার নামাজ আদায় করছিলেন। এ সময় তাদের ওপর এক অতর্কিত হামলা করা হয়। এতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুজাহিদ নির্মমভাবে শহীদ হন। এই ঘটনায় মুজাহিদদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। সৈয়দ আহমদ রহ. প্রত্যেককে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাবার অনুমতি দেন।কিন্তু অনেকেই তাকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি।তিনি যখন পাঠান্দের ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা করলেন তখন পাঠানরা তাকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল, তিনি সেই বিখ্যাত হাদীসটি বলেছিলেন- "মুমিন কখনো একই গর্তে বারবার পা দেয় না।"

অবশিষ্ট মুজাহিদদের নিয়ে সৈয়দ আহমদ (রহ) পেশোয়ার উপত্যকা থেকে কাগানের পার্বত্য এলাকা দিয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু পথিমধ্যে বালাকোটের কাছে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে সরদার সেরসিংয়ের নেতৃত্বে একটি বিরাট শিখ সৈন্যবাহিনী এসে সমগ্র এলাকা ঘিরে ফেলে। মূলত পাঠানদেরই একটি গ্রুপ শিখদের এখানে নিয়ে আসে। ফলে বালাকোটের ময়দানে সংঘটিত হয় চূড়ান্ত ও শেষ যুদ্ধ্ এই যুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে মুজাহিদ বাহিনী বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায়। সে দিন তার উস্তদা এর ছেলে এবং তাঁর প্রধান সেনাপতি শাহ ইসমাঈল শহীদের (রহ) এর সাহসিকতা দেখে সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় সৈয়দ আহমদ রহ., শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ. সহ প্রায় দুশ মুজাহিদ শহীদ হন। দিনটি ছিল ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের ৬ মে। এ যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিল তার সবাই চিল ঐশী প্রমের প্রজ্জ্বলিত শিখায় অস্থীর,তাই তারা সবাই ছিল শাহাদাতের জন্য অধীর। তাদের প্রতিটি লোমকূপ থেকে যেন উচ্চারিত হচ্ছিল- "প্রেমের বাজারে বন্ধুর গলিতে রয়েছে জীবনের মূল্য, এই সুসংবাদ লাভের পথে শির হয়েছে বাধা-তুল্য।"

এর মাধ্যমে সমাপ্ত হয় দীর্ঘ জিহাদী আন্দোলনের এক অধ্যায়। দীর্ঘ সংগ্রামের প্রবাহিত ধারা এখানে এসে থমকে দাড়ায়। রক্তের আখড়ে লেখা হয় বালাকোটের ঐতিহাসিক ট্রাজেডির কথা। তবে সৈয়দ আহমদ রহ. তার লক্ষ্যার্জনে অনেকাংশেই সফল হয়েছিলেন। সীমান্তের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের মানুষেরা শিখদের নির্যাতনের যাঁতাকল থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছিলেন। উপরন্তু পেশোয়ারকেন্দ্রিক একটি ইসলামী খেলাফত কায়েম করে চার বছরাধিককাল তা পরিচালনা করে সফল দৃষ্টান্তও তিনি স্থাপন করেছেন। যা পরবর্তী যুগের ঈমানদীপ্ত মুসলমানদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে সংঘটিত সিপাহী বিপ্লব, রেশমী রোমাল আন্দোলন, আযাদী আন্দোলন, দেওবন্দ আন্দোলন, আলীগড় আন্দোলন, তিতুমীরের আন্দোলন ,ফরায়েজী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবই বালাকোটের প্রেরণা ফসল। এজন্য বালাকোটের সেই ত্যাগ চিরকালই ভাস্বর হয়ে থাকবে।

লেখকঃ অগ্রপথিক।
সম্পাদনায়ঃ Duronto Pothik

কোন মন্তব্য নেই: